দিনব্যাপী শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ী সংঘর্ষের আদ্যোপান্ত


Journalist Tarek Aziz প্রকাশের সময় : ২০/০৪/২০২২, ১:২০ পূর্বাহ্ণ /
দিনব্যাপী শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ী সংঘর্ষের আদ্যোপান্ত

ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের সাথে নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীদের দিনব্যাপী সংঘর্ষ হয়েছে।

মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে সংঘর্ষ চলেছে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সংঘর্ষে আহত নাহিদ হোসেনের (২০) মৃত্যু হয়।

সংঘর্ষে একাধিক সাংবাদিকসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গুরুতর আহত শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক), সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজসহ রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে।

মঙ্গলবার সকাল থেকে থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে দিনব্যাপী। বিকেল ৫টার দিকে পুলিশ রাস্তা থেকে সরে গেলে শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে অবস্থান করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করে দেয়া হয়।

ব্যবসায়ী-শিক্ষার্থীর সংঘর্ষের সূত্রপাত-
শিক্ষার্থী এবং সিসিটিভি ফুটেজ সূত্রে জানা যায়, ব্যবসায়ীদের নিজেদের বিতণ্ডায় শিক্ষার্থীদের ডেকে আনলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।

সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নিউমার্কেটের-৪ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতেই ‘ওয়েলকাম’ ও ‘ক্যাপিটাল’ নামের দুটি ফাস্টফুডের দোকান। ইফতারের সময় হাঁটার রাস্তায় টেবিল বসিয়ে ইফতার সামগ্রী বিক্রি করতে বসাকে কেন্দ্র করে ওই দুই দোকানের কর্মীদের মধ্যে হাতাহাতি হয়।

এক দোকানির পরিচিত ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীকে ঢাকলে। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে সংঘর্ষ তৈরি হয়। এ সময় ঢাকা কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাত করে ব্যবসায়ীরা।

এরপর রাত সাড়ে ১১টার দিকে কলেজ ছাত্ররা এসে ৪ নম্বর গেট ভাঙতে শুরু করে। রাত ১২টার দিকে ছাত্ররা ২ নম্বর গেট খুলে মার্কেটে ঢুকে কিছুক্ষণ ভাঙচুর করে আবার বেরিয়ে যায়। এ সময় তাদের দুটি দোকান ভাঙচুর করতে দেখা যায়। তখন থেকে মূলত ব্যবসায়ীসহ হকাররা ছাত্রদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।

শিক্ষার্থীদের কথা ক্যাম্পাসের হলে ছড়িয়ে পরলে, হল থেকে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী নিউমার্কেট এসে জড়ো হয়। একপর্যায়ে শিক্ষার্থী এবং ব্যবসায়ীদের মাঝে তীব্র সংঘর্ষ তৈরি হয়।

সোমবার রাত ১২টা থেকে সাহরির পূর্বে ৩টা পর্যন্ত চলতে থাকে সংঘর্ষ। ওই সংঘর্ষে ৩৫ শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়াও সংঘর্ষে দুই ব্যবসায়ী আহত হয়েছে বলে জানানো হয়।

রাত ৩টার পর কিছুটা শান্ত হলেও মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে আবার সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষে একাধিক সাংবাদিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

সংঘর্ষে সাংবাদিক আহত-
সোমবার রাত ১২টা থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাংবাদিক আহত হয়েছে অন্তত ১০ জন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

প্রফেশনে থাকা অবস্থায় ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলতে গেলে সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়। এ সময় দীপ্ত টিভির রিপোর্টার সুমিত, এসএ টিভির ক্যামেরাম্যান কবির হোসেনসহ ১০ সাংবাদিক আহত হয়েছেন।

সাংবাদিকদের ওপর হামলার প্রতিবাদ করেছে ঢাকা রিপোর্টার্সর ইউনিট। মঙ্গলবার এক বিবৃতির মাধ্যমে ডিআরইউ-র সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু ও সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম হাসিব সাংবাদিকদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।

এছাড়াও তারা সাংবাদিকদের ওপর আঘাতকারীদের চিহ্নিত করে যথাপযোক্ত শাস্তির দাবি জানান তারা

শিক্ষকদের ওপর হামলা-
মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষের শুরুতে ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী এবং নিউমার্কেট ব্যবসায়ীরা পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান করলেও পুলিশ কিংবা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংঘর্ষ থামানোর কোনো ধরনের পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। সংঘর্ষে তীব্রতা অনুভব করে কলেজ প্রশাসন পুলিশের ঊর্ধতন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে এবং শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটের সময় নাঈমের গলি হয়ে রাস্তায় আসে।

সংঘর্ষ বন্ধ করা এবং দুই পক্ষকে সমাঝোতায় বসানোর উদ্দেশ্যে শিক্ষকরা নিউমার্কেটের দিকে রওয়ানা হলে ব্যবসায়ীরা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায়। পরে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় শিক্ষকরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন।

এ সময় শিক্ষকদের পক্ষ থেকে ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ টি এম মঈনুল হোসেন বলেন, আমরা সমঝোতার উদ্দেশ্যে বের হয়েছি। আমাদের অনেক শিক্ষার্থী এরই মধ্যে আহত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি। এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসা জরুরি। ওরা (ব্যবসায়ীরা) এমন আচরণ করতে পারে না। তারা আমার শিক্ষকের ওপর হামলা করেছে। আমার শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে।

এ সময় তিনি আরো বলেন, শিক্ষামন্ত্রণালয়ে অভিযোগ জানানো হয়েছে। আমার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কে নেবে!

শিক্ষার্থীদের রক্তে টিচার্স লাউঞ্জ রঞ্জিত-
একে একে আহত শিক্ষার্থীদের প্রশাসনিক ভবনে নেয়া হচ্ছে। কারো মাথায় আঘাত প্রাপ্ত। কেউ বা আবার হাত-পা আঘাত পেয়ে। হাত কেটে যাওয়া কিংবা পা কেটে যাওয়া, শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত নিয়ে আসা হচ্ছে এই ভবনে। প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে রেড ক্রিসেন্টের ভলেন্টিয়াররা।

এমন সময় মাথায় আঘাত প্রাপ্ত গুরুতর আহত অবস্থায় টিচার্স লাউঞ্জে নিয়ে আসা হয় এক শিক্ষার্থীকে। শিক্ষার্থীদের রক্তে ভিজে গেছে কলেজের টিচার্স লাউঞ্জ।

এমন দৃশ্যে অঝোরে কান্না করলেন ঢাকা কলেজের একাধিক শিক্ষিকা।

ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষিকা বলেন, আমার শিক্ষার্থীদের এ কি অবস্থা হচ্ছে! একে একে শিক্ষার্থীদের রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এমন দৃশ্য আমাদের প্রত্যাশিত নয়। এগুলো দ্রুত বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হোক।

হল বন্ধের ঘোষণায় উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা-
সকাল থেকে উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা যখন সংঘর্ষে লিপ্ত ঠিক এমন সময়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে হল বন্ধের ঘোষণা দেয় কলেজ প্রশাসন।

দুপুর ৩টা ৩০মিমিটে অধ্যক্ষের কার্যালয় থেকে এক বিজ্ঞাপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে আগামী ৫মে পর্যন্ত হল বন্ধের ঘোষণা দেয় কলেজ প্রশাসন।

এর তীব্র বিরোধিতা করে কলেজশিক্ষার্থীরা। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষের কার্যালয়ে ভাঙচুর করে এবং অধ্যক্ষকে অবরুদ্ধ করে রাখে।

প্রায় আধঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকায় পর জরুরি মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় অধ্যক্ষ।

টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপে মিটিং অসম্পূর্ণ থেকে যায়-
সকাল ১০টায় শিক্ষকদের জরুরি মিটিংয়ে বসার কথা থাকলেও উত্তেজনা এবং দফায় দফায় সংঘর্ষের কারণে মিটিংয়ে বসা সম্ভব হয়নি।

অবশেষে বিকেল ৪টায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস শিকদারের নেতৃত্ব মিটিং শুরু হয়।

মিটিংয়ের শুরু হওয়ার কিছুক্ষণপর ফের সংঘর্ষ শুরু হলে পুলিশ ক্যাম্পাসের ভেতরেও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করতে থাকে। একপর্যায়ে টিচার্স লাউঞ্জের পাশে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করলে মিটিং অসম্পূর্ণ রেখে বের হতে হয় শিক্ষকদের।

এ সময় অন্তত ১০জন শিক্ষক টিয়ারগ্যাসে আক্রান্ত হয়।

শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস শিকদার বলেন, এটা মেনে নেয়া যায় না। ক্যাম্পাসের ভেতরে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করার অধিকার পুলিশ প্রশাসনের নেয়।

ছাত্রলীগ সভাপতি সেক্রেটারির নির্দেশ উপেক্ষা-
কলেজশিক্ষক আলতাফ হোসেন সোহেল বলেন, আমরাও আমাদের শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছি। হল বন্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান করছি।

এ সময় তিনি আরো বলেন, কলেজে শিক্ষার্থীরা আহত। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। এমন সময় হল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত উচিত নয়।

শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, হল বন্ধ রাখা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। প্রয়োজনে লাশ হয়ে বাসায় ফিরবে তবুও হল বন্ধ করতে দেবো না।

অবশেষে সন্ধ্যার পর শিক্ষার্থীরা হলে অবস্থান করার শর্তে ক্যাম্পাসে ফিরে যায়৷

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com