জন্ম নিবন্ধন করতে ডাক্তারকে দিতে হয় ৩০০-৫০০ টাকা!
তারেক আজিজ
প্রকাশের সময় : ১৯/০৯/২০২১, ৬:১৯ অপরাহ্ণ /
০
চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের ডাক্তারপাড়া গ্রামের এনামুল হক (৫০) ইউনিয়ন পরিষদ হতে নিজের, স্ত্রীর ও ছেলের জন্ম নিবন্ধন করেছেন। ৩টি জন্ম নিবন্ধন করতে দিনমজুর এনামুলকে গুনতে হয়েছে ১২০০ টাকা। তারমধ্যে বয়স প্রমাণের জন্য এমবিবিএস চিকিৎসকের প্রত্যয়ণ নিতেই দিতে হয়েছে ৯০০ টাকা৷
একই গ্রামের বদিউজ্জামান (৬০) তার ছেলে আহাতারের জন্য জন্ম নিবন্ধন করেছেন। চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্রের জন্য তার কাছে নেয়া হয়েছে ৫০০ টাকা। শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওয়ার্ড বয় রাজিবুল ইসলাম বাবুকে টাকা দিয়ে প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন বদিউজ্জামান।
মো. মোজাম্মেল হকের স্ত্রী রোজিনা বেগম জানান, বড় ছেলের জন্ম নিবন্ধন ফি মাত্র ৮৫ টাকা হলেও ছোট ছেলের বেলায় তা হয়েছে ৪৫০ টাকা। ডাক্তার খরচ, ট্র্যাক্স সবমিলিয়ে এই টাকা নেয়া হয়েছে বলে তাকে জানায় ইউনিয়ন পরিষদ। গৃহবধূ জলি খাতুন বলেন, শুধুমাত্র খরচের বিষয় বিবেচনা করে দুই ছেলের জন্ম নিবন্ধন করছি না। কারন রাজমিস্ত্রী স্বামীর পক্ষে এতো ব্যয় বহন করা সম্ভব না। শুনেছি কারে কাছে ৫০০ টাকা, কারো কাছে ৩০০ টাকা ডাক্তারের ফিসহ বিভিন্ন খরচ নিচ্ছে। তাই আর জন্ম নিবন্ধন করতে যায়নি।
শুধুমাত্র চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্র নিতেই ৩০০-৫০০ টাকা ব্যয় হয় পাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের জনসাধারণের। পদ্মা পাড় ও চরাঞ্চলের এসব নিম্নআয়ের মানুষের সরলতার সুযোগে প্রত্যয়নপত্রের নামে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান চিকিৎসকরা৷ চিকিৎসা না দিয়েই শুধুমাত্র প্রত্যয়নপত্রের একটি সাক্ষরেই মিলছে ৩০০-৫০০ টাকা। এই কাজে যুক্ত রয়েছেন সরকারি হাসপাতালের দুই চিকিৎসক, অফিস সহকারী, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা, হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়।
স্থানীয় বাসিন্দা, গ্রাম পুলিশ, ইউনিয়ন পরিষদ ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা, ইউপি সদস্য সূত্রে জানা যায়, ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দীনের আমন্ত্রনে চলতি বছরের ২২ মে ইউনিয়ন পরিষদে আসেন রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের সাবেক মেডিকেল অফিসার এবং বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ প্যারাডাইস ডায়াগনস্টিক এ্যান্ড কনসালন্টেশন সেন্টারের চিকিৎসক রুবেল আহমেদ। সেদিন ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়েই শতাধিক প্রত্যয়নপত্র দেন ডাক্তার রুবেল আহমেদ৷ জনপ্রতি নেয়া হয় ৩০০-৫০০ টাকা করে৷ পরে এভাবে পরিষদে ডাক্তার এনে টাকার বিনিময়ে সনদ দেয়ার বিষয়ে প্রতিবাদ জানায় স্থানীয়রা।
এরপর থেকে দুইটি গ্রুপের মাধ্যমে টাকা দিয়ে প্রত্যয়নপত্র নিচ্ছেন ইউনিয়নবাসী। একটি গ্রুপে রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা সুজন। প্রত্যেকটি প্রত্যয়নের জন্য ৩০০-৫০০ টাকা তুলেন সুজন। এরপর তিনি এসব প্রত্যয়ন গ্রহণ করেন, রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের সাবেক মেডিকেল অফিসার ডাক্তার রুবেল আহমেদ। আরেকটি গ্রুপে টাকা নেন পাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই বাড়ি ও শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওয়ার্ড বয় রাজিবুল ইসলাম বাবু ও অফিস সহকারী আল-আমিন। তারা শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দুই চিকিৎসক ডাক্তার কামাল ও সুইটের মাধ্যমে প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করেন তারা।
পরিষদে ডাক্তার এনে প্রত্যয়নপত্র দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে এবিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা সুজন বলেন, পরিষদে চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্রের জন্য কোন টাকা নেয়া হয়না। অনেকেই বাইরে থেকে কাউকে টাকা দিয়ে এটি করতে পারে। পাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জালাল উদ্দীনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওয়ার্ড বয় রাজিবুল ইসলাম বাবু জানান, টাকা নিয়ে শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দুই চিকিৎসক ডাক্তার কামাল ও সুইটের মাধ্যমে প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে এখন থেকে নতুন নিয়মে কোনপ্রকার টাকা পয়সা ছাড়াই প্রত্যয়ন দেয়ার বিষয়ে সিধান্ত নেয়া হয়েছে। এমনকি প্রত্যয়নপত্রগুলো সরকারি হাসপাতালে নয়, প্রাইভেট ক্লিনিক থেকে নেয়া হয় বলে জানান ওয়ার্ড বয় রাজিবুল ইসলাম বাবু ও অফিস সহকারী আল-আমিন।
শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক সুইট বলেন, আগে নেয়া হতো। তবে এখন প্রত্যয়নপত্রে কোন টাকা নেয়া হয় না। এদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ প্যারাডাইস ডায়াগনস্টিক এ্যান্ড কনসালন্টেশন সেন্টারের চিকিৎসক রুবেল আহমেদের সাথে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা পরিচয়ে ৭৭টি প্রত্যয়নপত্র করতে চাইলে প্রত্যেকটির জন্য তিনি ৩০০ টাকা করে দাবি করেন। এবিষয়ে কথপোকথনের অডিও রেকর্ড রয়েছে প্রতিবেদকের কাছে। তার চেম্বারে দেখা করে সাংবাদিক পরিচয় জানতে পারলে এবিষয়ে কথা না বলে চলে যান।
সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, সরকারি হাসপাতালে জন্ম নিবন্ধনের জন্য নাগরিকদের থেকে টাকা নেয়ার বিষয়ে চিকিৎসকদের বিধিনিষেধ দেয়া আছে। তবে প্রাইভেট ক্লিনিক বা চেম্বারে টাকা নিলে এবিষয়ে আমাদের কিছু করনীয় নেই। তবে চিকিৎসা না দিয়ে শুধু প্রত্যয়ন দিয়ে টাকা নেয়ার বিষয়টি কতটুকু নৈতিক, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রাইভেট ক্লিনিক বা চেম্বারে চিকিৎসা দিয়ে টাকা নিতে পারে। কিন্তু শুধু প্রত্যয়নপত্র দিয়েই টাকা নেয়াটা সঠিক নয়।
Post Views: 1,558
আপনার মতামত লিখুন :